অমুসলিমদের একটা বড় আলোচনার বিষয় হল তারা জয়নব(রাঃ) এর সাথে রাসূল(সাঃ) এর বিয়ে নিয়ে অনেক কথা বলেন। তাদের বাজে মন্তব্যের কোন উত্তর দিতে চাই না। তবে যারা একটু মাথা খাটিয়ে জানার জন্য প্রশ্ন করেন তাদের উত্তর দিতে এসেছি। অনেকেই প্রশ্ন করেন, পুত্রবধুকে বিয়ে করার কি দরকার ছিল?? অনেকে বলেন, তাদের নিজের মেয়ের মত কাছে রেখে দিলে কি সমস্যা ছিল?? সকল বিষয় নিয়েই আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
এই বিয়ে নিয়ে আলোচনার আগে আমাদের সবারই কিছু প্রেক্ষাপট জানা দরকার।
জয়নব(রাঃ) রাসূল(সাঃ) এর ফুফাতো বোন। তিনি প্রথমে কুরাইশদের মধ্যে থেকে কাউকে বিয়ে করেছিলেন যার নাম জানা যায় নি। বিধবা হয়ে জয়নব(রাঃ) তার ভাইয়ের সাথে ছিলেন। সম্ভবত ৬২৫ খ্রীষ্টাব্দে রাসূল(সাঃ) জয়নব(রাঃ) এর কাছে যায়েদ(রাঃ) এর বিয়ের প্রস্তাব দেন। যায়েদ(রাঃ) ছিলেন একজন কৃতদাস এবং উপহার স্বরূপ তাকে রাসূল(সাঃ) কে দেওয়া হয়। রাসূল(সাঃ) এর ছেলে সন্তানরা শিশু বয়সে মারা যাবার কারণে রাসূল(সাঃ) যায়েদ(রাঃ)কে অনেক ভালবাসতেন। এবং তিনি তাকে পালক পুত্রের মত দেখতেন। সবাই তাকে যায়েদ বিন মোহাম্মদ(রাঃ) বলে ডাকতেন। পরবর্তীতে কুরআন এর আয়াত নাযিল হলে যায়েদ(রাঃ) কে তার পিতৃ পরিচয়ে ডাকা হত।
জয়নব(রাঃ) প্রথমে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। কারণ তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের এবং যায়েদ(রাঃ) একজন কৃতদাশ ছিলেন। পরে তাকে বুঝানোর পর জয়নব(রাঃ) সম্মতি দেন এবং বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু সমস্যায় তাদের বিয়ে ভেংগে যায়। জাযেদ(রাঃ) জয়নব(রাঃ) সম্পর্কে রাসূল(সাঃ) এর কাছে নালিশ করলে রাসূল(সাঃ) বলেন- আল্লাহকে ভয় কর এবং তাকে স্ত্রী হিসেবে রাখ। [১]
কিন্তু পরে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে নির্দিষ্ট সময় পর রাসূল(সাঃ) জয়নব(রাঃ) কে তার সম্মতিতেই বিয়ে করেন। এবং সেই বিয়েতে প্রায় ৭০ জন অতিথি ছিলেন যা অন্য কোন বিয়েতে সম্ভবত ছিল না। এই হল সংক্ষিপ্ত কাহিনী।
২. আল্লাহ কুরআন এ বলেছেন-
আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন; তাকে যখন আপনি বলেছিলেন, তোমার স্ত্রীকে তোমার কাছেই থাকতে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর। আপনি অন্তরে এমন বিষয় গোপন করছিলেন, যা আল্লাহ পাক প্রকাশ করে দেবেন আপনি লোকনিন্দার ভয় করেছিলেন অথচ আল্লাহকেই অধিক ভয় করা উচিত। অতঃপর যায়েদ যখন যয়নবের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, তখন আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে। (৩৩ঃ৩৭)
শেষের কথাটা খেয়াল করুন। বিয়ের পিছনে এটাও একটা কারণ।
"আমি তাকে আপনার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করলাম যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্ররা তাদের স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে সেসব স্ত্রীকে বিবাহ করার ব্যাপারে মুমিনদের কোন অসুবিধা না থাকে। আল্লাহর নির্দেশ কার্যে পরিণত হয়েই থাকে।"
৩. আরবে একটা কুসংস্কার ছিল। পালিত পুত্রকে বা সন্তানকে নিজের পুত্রের বা সন্তানের মত মনে করা হত, যা ইসলামে যায়েজ না। কারণ এতে সম্পত্তি, পর্দা থেকে শুরু করে অনেক হিসেবে বিবাদে লিপ্ত হবার সম্ভাবনা আছে। এবং বড় পাপের আশংকা আছে। এই কারণে ইসলাম এটাকে অনুমতি দেয় নাই। যেহেতু ইসলামে পালিত পুত্রকে নিজের পুত্রের মত গন্য করা হয় না তাই পালিত পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করাতে কোন বাধা নাই। এখানে শশুর ও পুত্রবধুর প্রশ্নই আসে না।
৪. একটা মেয়ের স্বামী তালাক দিলে অথবা মারা গেলে যখন সে সারাজীবন বিধবা হয়ে কাটায় এটা খুব কষ্টের পরিস্থিতি হয়। লোকমুখে বিভিন্ন কথা হয় এবং এটা নারী অধিকার এর পরিপন্থী। জয়নব(রাঃ) এর এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতেই এই বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
৫. যারা বলেন- তাকে পুত্রবধুর মর্যাদা দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলে ভাল হত, যেভাবে নিজের ছেলের স্ত্রী থাকে। যদি এমন বিধান দেয়া হত- ঐ বিধবা মেয়েকে বাধ্যতামূলকভাবে শশুর এর কাছে থাকতে হবে তাহলে অমুসলিমরা ও বিধর্মীরাই বলত- ইসলাম নারীর বিয়ের অধিকার ক্ষুন্ন করেছে। তাকে বিধবা অবস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে থাকা অমানবিক। ইসলাম সবচেয়ে বাস্তবধর্মী ও মানবতার ধর্ম। এখানে অমানবিক কাজের কোন স্থান নাই। এইজন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পার হবার পর সেই পুত্রবধু/সেই মেয়ে তার জন্য জায়েজ এমন যে কাউকে বিয়ে করতে পারেন। এই বিধানই বাস্তবধর্মী ও মানবতার পক্ষে অগ্রবর্তী। ভাল করে ভেবে দেখুন।
৬. আবার তার মানে এই না, এটা আল্লাহ আপনার জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। এমন না যে, আপনার পালিত পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অবশ্যই বিয়ে করতে হবে। আপনি ইচ্ছা করলে এমন বিয়ে করতে পারেন, নাও করতে পারেন। আপনার ইচ্ছা। তবে এটাকে জায়েজ করা হয়েছে যদি উভয়ে সম্মতি দেয়।
৭. এই বিয়েতে এত অতিথির উপস্থিতি প্রমাণ করে, আরবের সবার মধ্যে থেকে এই কুসংস্কার যেন দূর হয় এই জন্য এই বিয়ের বিশেষ ভূমিকা আছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল- সব অতিথিরা সবাইকে যেন এই বার্তা পৌছে দিতে পারে। এবং দ্রুত এই কুসংস্কার থেকে সবাই মুক্ত হতে পারে।
৭. এই বিয়েতে এত অতিথির উপস্থিতি প্রমাণ করে, আরবের সবার মধ্যে থেকে এই কুসংস্কার যেন দূর হয় এই জন্য এই বিয়ের বিশেষ ভূমিকা আছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল- সব অতিথিরা সবাইকে যেন এই বার্তা পৌছে দিতে পারে। এবং দ্রুত এই কুসংস্কার থেকে সবাই মুক্ত হতে পারে।
আপনার একটা পালিত পুত্র আছে। সে একজন কৃতদাস ছিল, পরে আপনি তাকে পালিত পুত্রের মর্যাদা দিয়েছেন। তার সাথে একটা মেয়ের বিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর আপনার পালিত পুত্র সেই স্ত্রীকে তালাক দিল। সেই মেয়ের সাথে আপনার পালিত পুত্রের কোন সম্পর্ক নেই। তাহলে সেই মেয়ের ভবিষ্যত কি?? সে কি আর স্বামীর ভালবাসা পাবে না?? এখন এই মুহুর্তে আপনি কি করবেন?? আমি জানি আপনার মাথায় দুইটা সমাধান ঘুরপাক খাবে যে দুইটাই জয়নব(রাঃ) এর ক্ষেত্রে সম্ভব ছিল না এবং তা বাস্তবসম্মত না। নিচে তা বর্ণনা করা হল-
যদি যায়েদ(রাঃ) এর তালাক এর পর রাসূল(সাঃ) ও জয়নব(রাঃ) এর বিয়ে না হত- তাহলে দুইটা জিনিস হতে পারত,
১. জয়নব(রাঃ) কে সারাজীবন বিয়ে না করে বিধবার মত থাকতে হত।
২. জয়নব(রাঃ) কে অন্য কাউকে বিয়ে করে সংসার করতে হত।
এই দুইটাই তখন সম্ভব ছিল না। কারণ একটা মেয়ে সারাজীবন বিধবার মত পার করা অনেক বেশী অমানবিক, কষ্টে পরিপূর্ণ। যারা এমন পরিস্থিতিতে থাকে তারাই এটা বুঝতে পারে। আর একজন কৃতদাসের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে এবং জয়নব(রাঃ) কিছুটা রাগী হবার কারণে অন্যরা বিয়েতে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তাই অন্য কাউকে বিয়ে করার রাস্তাও তেমনভাবে খোলা ছিল না। এভাবে সারাজীবন পার করা যায় না। এবং যদি অন্য কেউ বিয়ে করত তাহলে এই কুসংস্কার দূর হত না। সমাজে এটা থেকেই যেত। এতে সম্পত্তি ও পর্দা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফিতনার আশংকা ছিল।
এই কারণেই আল্লাহর নির্দেশে রাসূল(সাঃ) জয়নব(রাঃ) কে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জয়নব(রাঃ) সম্মতি দিলে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। আরব সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর হয়। জয়নব(রাঃ) এর কষ্টের জীবন পার হয়ে সুখী জীবন যাপন করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন